কিভাবে বসে খাওয়া সুন্নত

কিভাবে বসে খাওয়া সুন্নত


খাবার খাওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুসরণ করে বসে খাওয়া উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈনন্দিন জীবনে করা প্রত্যেকটি  কাজ আমাদের জন্য সুন্নত। তিনি যেভাবে বসে খেতেন সেইভাবে বসে খাবার খাওয়া আমাদের জন্য সুন্নাত। তাই আমাদের আজকের এই পোস্টের আলোচ্য বিষয় হলো কিভাবে বসে খাওয়া সুন্নত এবং ইসলামে খাবার খাওয়ার নিয়ম



কিভাবে বসে খাওয়া সুন্নত


আমরা আজকে এই পোস্টে আলোচনা করব কিভাবে বসে খাওয়া সুন্নত


কিভাবে বসে খাওয়া সুন্নত


বিভিন্ন হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে বসে খেতেন সে সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।


আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রাঃ)  বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বড়ো কড়াই ছিলো। তা চারজন লোক বহন করতো। পাত্রটির নাম ছিলো ’গাররাআ।’ বেলা কিছুটা উপরে উঠলে এবং লোকের চাশতের সালাত আদায় শেষ হলে পাত্রটি নিয়ে আসা হলো। অর্থাৎ তাতে ঝোল মিশ্রিত রুটি ছিলো। লোকেরা এর চারিদিকে বসলো। লোকের আধিক্যের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁটু গেড়ে বসলেন। এক বেদুঈন প্রশ্ন করে বললো, এটা কিভাবে বসা হলো! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আমাকে ভদ্র ও সম্মানিত বান্দা বানিয়েছেন। তিনি আমাকে অবাধ্য ও উচ্ছৃঙ্খল বানাননি। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ পাত্রের কিনারা থেকে খাও এবং মধ্যখান ছেড়ে দাও। এতে বরকত হবে।

এ সম্পর্কে আবু দাউদ হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ের পাতা বিছিয়ে দুই হাঁটুর উপর ভর দিয়ে নামাজের মত করে বসে খাবার খেতেন।


এ সম্পর্কে সহিহ মুসলিম হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক সময় দুই পায়ের উপরে খাড়া হয়ে বসে উপরি বৈঠকে খাবার খেয়েছেন। এ সম্পর্কে আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, ”আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দুই পায়ের উপরে খাড়া হয়ে বসে উপর বৈঠকে খেজুর খেতে দেখেছি। ”


এছাড়া আরও একটি হাদিসে এসেছে, খাবার খাওয়ার সময় বাম পা বিছিয়ে  ডান পা দাড় করিয়ে বসে খাওয়া। তবে এই হাদিসটি উপরের দুটি হাদিস থেকে তুলনামূলক দুর্বল।



ইসলামে খাবার খাওয়ার নিয়ম


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক যে নিয়ম মেনে খাবার খেয়েছেন সেই নিয়ম আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। নিচে ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক খাবার নিয়ম দেওয়া হলঃ

ওমর ইবনে আবু সালামা (রা.) বলেন, আমি ছোটবেলায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমতে ছিলাম। খাবার বাসনে আমার হাত ছোটাছুটি করত। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, হে বৎস, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ডান হাতে আহার করো এবং তোমার কাছের থেকে খাও। এরপর থেকে আমি সব সময় এ নিয়মেই খাদ্য গ্রহণ করতাম। (অর্থাৎ নিজের সামনে থেকে আহার গ্রহণ করতাম)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৭৬)


১. খাবার গ্রহণের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা


খাবার গ্রহণের আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা উচিত কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম খাবার গ্রহণের আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতেন। আর সাহাবীদেরও বিসমিল্লাহ বলতে উৎসাহিত করতেন।


রাসুল (সা.)  বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে ও ডান হাত দ্বারা খানা খাও। এবং তোমার দিক হতে খাও। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ৫১৬৭, তিরমিজি, হাদিস নং : ১৯১৩)


২.বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে


আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যখন তোমরা খানা খেতে শুরু করো তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও তাহলে বলো  ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওআখিরাহ’। (আবু দাউদ, হাদিস নং : ৩৭৬৭, তিরমিজি, হাদিস নং: ১৮৫৮)


৩.হাত দিয়ে শুরু ও শেষ করা


হাত ধুয়ে খাবার গ্রহণ করতে হয় না হয় নানা ধরনের অসুখ অসুখ হতে পারে। আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম খাবার আগে হাত পরিষ্কার করার জন্য বলেছেন।আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) পানাহারের আগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন। (মুসনাদে আহমাদ)


অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) খাওয়ার পর কুলি করতেন এবং হাত ধৌত করতেন। (মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজাহ)


. দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া




আনাস (রা.) বলেন, আমাদের রাসূল (সাঃ) পায়াবিশিষ্ট বড় পাত্রে খাবার খেতেন না। কাতাদা (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে কীসের ওপর খানা খেতেন? তিনি বললেন, ‘চামড়ার দস্তরখানের ওপর। ’ (বোখারি : ৫৩৮৬)

৫.ডান হাত দিয়ে খাওয়া




ডান হাত দিয়ে খানা খাওয়া উত্তম। আমাদের শেষ নবী রাসূল্লাহ (সাঃ) আজীবন ডান হাত দিয়ে খাবার খেতেন। বাম হাত দিয়ে খাবার খেতে খেতেন না। বাম হাত দিয়ে খাবার খেতে নিষেধ করেছেন । কারণ শয়তান বাম হাত দিয়ে খাবার খায়। 


ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বাম হাত দ্বারা খাবার খেয়ো না ও পান করো না। কেননা শয়তান বাম হাতে খায় ও পান করে। ’ (বুখারি, হাদিস নং: ৫৩৭৬; মুসলিম, হাদিস নং: ২০২২)


৬.হাত চেটে খাওয়া


আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খাওয়ার সময় সর্বদা হাত চেটে খেতেন হাতে কিছু লেগে থাকলে তা চেটে খেতেন। না চাটা পর্যন্ত হাত কখনো  মুছতেন না বা ধুতেন না। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করবে, তখন হাত না চাটা পর্যন্ত তোমরা হাতকে মুছবে (ধোয়া) না। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ৫২৪৫)


৭.আঙুল চেটে খাওয়া



খাবার খাওয়ার সময় ডান হাতে খাওয়া, হাত এবং আঙ্গুল চেটে খাওয়া উচিত। আঙ্গুল চেটে খেলে বরকত লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। কারণ খাবারের বরকত কোথায় আছে মানুষ তা জানে না এজন্যে আঙ্গুল চেটে খাওয়া উচিত। 


আমাদের শেষ নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করো তখন আঙুল চেটে খাও। কেননা বরকত কোথায় রয়েছে তা তোমরা জানো না। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ১৯১৪)


৮.পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া



খাবার গ্রহণের সময় কখনো কখনো থালাবাসন থেকে অথবা খাবার মুখে নেয়ার সময় এক দুইটি ভাত, রুটির টুকরা কিংবা অন্য কোন খাবার পড়ে যায়। সম্ভব হলে এগুলো তুলে পরিষ্কার করে খাওয়া উচিত কারণ এগুলো ফেলে রাখলে শয়তান এই খাবারগুলো খেয়ে থাকে। 


আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর খাবার কালে যদি কোন খাবার পড়ে যেত তাহলে তিনি তুলে পরিষ্কার করে ওই খাবার খেতেন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের খাবার আহারকালে যদি লুকমা পড়ে যায়, তাহলে ময়লা ফেলে তা ভক্ষণ করো। শয়তানের জন্য ফেলে রেখো না। ’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ১৯১৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৩৪০৩)


৯.হেলান দিয়ে না খাওয়া



কোন কিছুর উপর হেলান দিয়ে খাবার খেতে নিষেধ করেছে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম। হেলান দিয়ে খাবার খেলে পেট বড় হয়ে যায়।পেট বড় হয়ে গেলে খিদা বেশি লাগে এবং বেশি খেতে হয় বলে নানান ধরনের রোগে আক্রান্ত করে। অনেক ক্ষেত্রে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়। 


আবু হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর দরবারে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বলেন, আমি টেক লাগানো অবস্থায় কোনো কিছু ভক্ষণ করি না। (বুখারি, হাদিস নং: ৫১৯০, তিরমিজি, হাদিস নং: ১৯৮৬)



১০.খাবারের দোষ-ত্রুটি না ধরা


ভালো করে খাবার রান্না করতে জানলেও অনেক সময় খাবার রান্না ভাল হয় না দোষ ত্রুটি থেকেই যায়। কিন্তু এ নিয়ে পরিবারের সাথে ঝগড়াঝাটি করা উচিত নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কখনো হালাল খাবারের দোষ ত্রুটি ধরতেন না। 



আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)  কখনো খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না। তার পছন্দ হলে খেতেন, আর অপছন্দ হলে খেতেন না। (বুখারি, হাদিস নং : ৫১৯৮; ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৩৩৮২)



১১.খাবারে ফুঁ না দেওয়া





মানুষের মুখে অনেক ধরনের ভাইরাস থাকে তার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। গরম খাবার বা পানীয় ঠান্ডা করার জন্য অনেকে ফু দেয় এই ফুয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রোগ  খাবার ও পানীয়তে প্রবেশ করে। এজন্য আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম খাবারে বা পানীয়তে ফু দিতে নিষেধ করেছেন। 


ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কখনো খাবারে ফুঁ দিতেন না। কোনো কিছু পান করার সময়ও তিনি ফুঁ দিতেন না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৩৪১৩)


১২.খাবারের শেষে দোয়া পড়া




মানুষ খাবার বা রিযিকের জন্য প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে। আল্লাহতালায় কষ্টের বিনিময় খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। আল্লাহ তায়ালা খাবারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে আমাদের প্রতি অনেক বড় দয়া অনুগ্রহ করে। আল্লাহ তা'আলার এই দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত এবং এটা সভ্যতা ও শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। খাবার গ্রহণ শেষে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা অপরিহার্য শুকরিয়া আদায়ের দোয়া ও আমাদের শেষ নবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাম শিখিয়েছেন। 

খাবার শেষে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতেন এবং দোয়া পড়তেন। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) খাবার শেষ করে বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহি হামদান কাসিরান ত্বয়্যিবান মুবারাকান ফিহি, গায়রা মাকফিইন, ওলা মুয়াদ্দায়িন ওলা মুসতাগনা আনহু রাব্বানা। ’ তিনি কখনো এই দোয়া পড়তেন: ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আতআমানা ওয়াছাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন। ’  (বুখারি, হাদিস নং : ৫৪৫৮)



সর্বোপরি রাসুল (সাঃ) এর সুন্নতগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে জীবন অনেক সুন্দর ও সার্থক হবে এবং জান্নাত পাওয়ার সহজ হবে। আল্লাহ আমাদের জান্নাত পাওয়া সহজ করে দেন। আমিন।

*

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم